কলকাতা: ৩৪-এর যুবক এখন বিশ্বের একাংশের কাছে ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’। আমেরিকার বুকে দখিনা হাওয়াকে একা ঠেকিয়েছেন তিনি। নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন তরুণ, মুসলিম এবং সর্বোপরি একজন ডেমোক্র্যাট হিসাবে। তবে এই পরিচয়ের ফাঁকে ঢাকা পড়েনি তাঁর আরও একটি পরিচয়। তা হল বামপন্থী। ট্রাম্পের ‘চোখ রাঙানিকে’ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এখন নিউ ইয়র্কের সর্বকনিষ্ঠ মেয়র হয়েছেন জ়োহরান মামদানি। কেউ কেউ বলছেন, একুশ শতকের বামপন্থীদের চেহারাটা ঠিক এরকমই হয়।
কে এই মামদানি?
৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩৪ বছর বয়সী মামদানি এখন নিউ ইর্য়কের নির্বাচিত মেয়র। আমেরিকার রাজনীতিতে ‘কমিউনিস্ট’ মুখ। মঙ্গলবার মেয়র নির্বাচনে জয়লাভ করে ইতিহাস তৈরি করেছেন তিনি। ১০০ বছর পর সর্বকনিষ্ঠ মেয়র পেয়েছে নিউ ইয়র্ক শহর। পাশাপাশি, আমেরিকার অন্যতম শহরে প্রথম মুসলিম মেয়রও এই মামদানিই।
বলে রাখা প্রয়োজন, নিউ ইয়র্কের সদ্য নির্বাচিত মেয়রের সঙ্গে রয়েছে ভারতের যোগ। জ়োহরানের মা ভারতের বিখ্যাত পরিচালক। নাম মীরা নায়ার। বাবা উগান্ডার শিক্ষাবিদ মাহমুদ মামদানি। জ়োহরানের শৈশব কখনও কেটেছে উগান্ডায়, কখনও বা আমেরিকায়। তবে ১৯৯৮ সালে সাত বছর বয়সে পাকাপাকি ভাবে নিউ ইয়র্কে চলে আসে গোটা মামদানি পরিবার। ভারত থেকে ভৌগলিক ভাবে জ়োহরানের দূরত্ব থাকলেও, রাজনৈতিক ও আত্মীক ভাবে তিনি চিরকালই থেকেছেন ভারতীয়।
মঙ্গলবার জয়ের পর তিনি স্মরণ করেছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর-বাণী। ভারত স্বাধীনতা লাভের পর মধ্যরাতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন নেহেরু। মামদানীর মুখে শোনা গিয়েছিল ঠিক সেই অক্ষর, সেই শব্দ ও সেই বাক্য়গুলিই। তিনি বলেছিলেন, ‘এটা একটা যুগের অবসান। দীর্ঘদিন ধরে চেপে রাখা একটা জাতির আত্মা নতুন ভাষা খুঁজে পেল।’
রাজনীতিতে পাশ মামদানি
২০২০ সালে সর্বপ্রথম নিউ ইর্য়ক অ্যাসেম্বিলিতে সর্বপ্রথম নির্বাচিত হন তিনি। তবে রাজনীতিতে যে এই বছর প্রথম পা দিয়েছিলেন তিনি এমনটা নয়। ২০১৫ সালে আলি নাজমির হয়ে প্রচারে নামেন মামদানি। ২০১৭ সালে যোগদান করেন আমেরিকার ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে। এরপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে নেপথ্যে থেকেই কাজ করেছেন তিনি। বলা চলে, এই কয়েক বছর রাজনীতিটাকে আয়ত্তে আনছিলেন মামদানি। এরপর জীবনের পট পরিবর্তন।
উল্লেখ্য, ডেমোক্র্য়াটদের হয়ে ভোটের ময়দানে নামতেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আক্রমণের মুখে পড়েন জ়োহরান মামদানি। তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক তোপ দাগেন ট্রাম্প। এমনকি, মামদানিকে জেতালে নিউ ইয়র্ক শহরের সমস্ত অনুদানও বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি। তবে মানুষ তাতে বিশেষ পাত্তা দেয়নি। পাত্তা দেননি মামদানিও। রিপাবলিকানদের বর্ষীয়ান প্রার্থীকে ভোটের ময়দানে মুখ থুবড়ে ফেলেন তিনি। বাজিয়ে দেন বিজয় শঙ্খ।
কোন শর্তে জিতলেন মামদানি?
মামদানি নিজে অভিবাসী। নিউ ইয়র্কের একটা বড় অংশের মানুষও অভিবাসী। আর সেটাই যেন ভোটের লড়াইয়ে ‘ডিভিডেন্ড’হয়েছে তাঁর। শহরের মোট ৫০ শতাংশ মানুষের সমর্থন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু শুধুই কি অভিবাসী ফ্যাক্টর? ওয়াকিবহাল বলছে, না ঠিক তেমন নয়। বরং রোটি, কাপরা, মাকান- মামদানির প্রচারের মূল স্তম্ভই ছিল এই তিনটি। একেবারে সাধারণ, যে কথা জনসাধারণের তা-ই নিজের প্রচারে তুলে ধরেছিলেন তিনি। বর্তমানে বিশ্বে বাড়ি ভাড়ার খরচের নিরিখে শীর্ষে নিউ ইয়র্ক। মামদানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেই বাড়ন্ত ভাড়ায় লাগাম টানার। পাশাপাশি, নিউ ইয়র্কের সকল গণপরিবহন পরিষেবা, বিশেষ করে বাসে আর কোনও ভাড়া লাগবে না বলেই প্রতিশ্রুতি তাঁর। আর মামদানির চোখে এটাই সত্যিকারের ‘আমেরিকান ড্রিম’।
শক্তি পাচ্ছেন বামপন্থীরা
মামদানির জয় নতুন করে শক্তি জোগাচ্ছে বামপন্থীদের। তরুণ রক্তই বিপ্লব আনতে পারে, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন নিউ ইয়র্কের সদ্য নির্বাচিত মেয়র। গোটা বিশ্বজুড়ে যখন দখিনা হাওয়া। তখন মামদানি মনে করিয়েছেন, ‘লেফ্ট ইজ রাইট’। আর শুধু মামদানিই কেন, বামপন্থী জয়গাঁথা লিখেছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মারও। কিন্তু বাংলা কি এসব কাহিনী থেকে বিচ্যুত? মামদানির জয়ের পর তাঁর নিজের দেশ উগান্ডায় নতুন করে এসেছে স্বপ্নের জোয়ার। মামদানির জয় ভোরের আলোর মতো ফুটে উঠেছে উগান্ডার বামপন্থী দলগুলির সামনে। নতুন করে উঠে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে ওই দেশের বামপন্থীরা। কিন্তু এই স্বপ্ন কি বাংলার তরুণ ‘কমিউনিস্টরা’ দেখছেন না?
হাওয়া বদলাচ্ছে, বামপন্থা ‘বাতিল’ ধারণা নয় বলেই দাবি শতরূপ ঘোষের। তাঁর কথায়, ‘যে মাটি থেকে বামপন্থা নিয়ে এত অপপ্রচার, সেই মাটিতেই মানুষ বামপন্থীদের গ্রহণ করছে। এই ঘটনা সত্যিই আমাদের উৎসাহিত করে। নিশ্চয়ই আমরা বাংলাতেও এর বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারব। দুই-দুই চার হয় না। তবে এই ঘটনা আমাদের বোঝায়, সময়ের পরিবর্তন ঘটবেই।’
২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া আসার পর বামপন্থীদের রাজনৈতিক জীবনেও যেন অন্ধকার নেমেছে। সেই বছর বিধানসভা ভোটে মোট ৬২টি আসন জিতেছিল সিপিএম-সহ বামফ্রন্ট। ২০১৬ সালে সেই সংখ্য়া পড়ে গিয়েছিল ৩২টি আসনে। যা একুশ আসতে-আসতে মিশে গেল শূন্য। একই বেহাল দশা নজরে এল লোকসভা নির্বাচনেও। কিন্তু এই হাওয়া ঘুরবে কবে? সেটাই এখন প্রশ্ন। এদিন এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য বলেন, ‘মানুষের জীবনে পুঁজিবাদ সঙ্কট ডেকে এনেছে। যেখানে বেকারত্ব রয়েছে, জাতপাত রয়েছে, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য় রয়েছে। তবে সেই সঙ্কট থেকে মানুষ বেরনোর চেষ্টাও করছে। আর এই আবহে মামদানির উত্থান সত্যিই প্রেরণা নেওয়ার মতো। মামদানি কমিউনিস্ট নন, তবে যে কথাগুলো রাজনীতির মূলস্রোতে নিয়ে আসছেন, সেগুলো সবারই তুলে ধরা প্রয়োজন।’





Leave a Comment